করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে ১৩ কোটি মানুষ অনাহারের শিকার হতে পারে

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে ১৩ কোটি মানুষ অনাহারের শিকার হতে পারে

একটি বড় গাছের কোটরে খেলতে ভালোবাসতো দুই বছর বয়সী এমিলি ওয়ামোনো। এমিলিরা যে গ্রামটিতে থাকতো সেটির নাম মেলিয়ানডো, গিনির এক জঙ্গলের একেবারে ভেতরে এই গ্রাম। কিন্তু গাছের এই কোটরটির খোঁজ পেয়ে গিয়েছিল অন্য কিছু প্রাণী। কিছু বাদুড়। খেলতে যাওয়া শিশুরা মাঝে-মধ্যে এই বাদুড়গুলো ধরে নিয়ে আসতো। এরপর এগুলো রান্না করে তারা খেত।

এরপর একদিন এমিলি অসুস্থ হয়ে পড়ল। ২০১৩ সালের ২৪ শে ডিসেম্বর এক ভয়ঙ্কর এবং রহস্যজনক অসুখে এমিলি মারা গেল। এরপর এই রোগে আক্রান্ত হলো তার মা, বোন এবং দাদী। তাদেরও মৃত্যু ঘটলো একই রোগে। তাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর এই রহস্যজনক অসুখ যেন আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। ২০১৪ সালের ২৩শে মার্চ নাগাদ সেখানে অন্তত ৪৯টি এ ধরনের অসুস্থতা এবং ২৯ জনের মৃত্যু ঘটলো। বিজ্ঞানীরা পরে নিশ্চিত করেছিলেন যে এটি ছিল ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ। এর পরের সাড়ে তিন বছর ধরে সারা পৃথিবী আতঙ্কের সঙ্গে দেখেছে কীভাবে এই ভাইরাসের আক্রমণে অন্তত ১১,৩২৫ জনের মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু প্রাণঘাতী ইবোলা ভাইরাসের বিস্তারের পাশাপাশি কিন্ত ঘটে চলেছিল আরেক ট্রাজেডি। এই রোগের বিস্তার স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার ওপর মারাত্মক চাপ তৈরি করেছিল। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী মারা গিয়েছিল। বড় বড় হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেগুলো খোলা ছিল সেগুলো ইবোলা নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে অন্য রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না। ইবোলা ভাইরাসের বিস্তার সবচেয়ে বেশি ঘটেছিল সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া এবং গিনিতে। সেখানে লোকজন যতটা সম্ভব স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাকে এড়িয়ে চলছিল। তারা আতঙ্কে ছিল এই রহস্যজনক নতুন অসুখ নিয়ে।

কিন্তু একই সঙ্গে তারা ভয় পাচ্ছিল ডাক্তারদের। সাদা অ্যাপ্রোন পরা ডাক্তাররা যেন হঠাৎ জীবন রক্ষাকারীর পরিবর্তে যমদূতের প্রতীক হয়ে উঠেছিল। স্বাস্থ্যকর্মীদের যেন হঠাৎ সবাই সামাজিকভাবে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। দু`হাজার সতের সালে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এর ফলে ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় আফ্রিকার এই দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা নাটকীয় ভাবে কমে গিয়েছিল। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় চিকিৎসা সেবা চেয়েছেন এমন গর্ভবতী নারীর সংখ্যা কমে যায় ৮০ শতাংশ। টিকা নেয়ার হারও কমে যায় মারাত্মকভাবে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুদের সংখ্যা কমে যায় ৪০ শতাংশ। ইবোলা ভাইরাসের বিস্তার শেষ পর্যন্ত ঠেকিয়ে দেয়া গেলো সম্মিলিত এবং ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কিন্তু অন্যদিকে দেখা গেল, ইবোলা ভাইরাস ঠেকাতে যা যা করা হয়েছিল, তার ফলে অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। অর্থাৎ, ইবোলা ভাইরাসে প্রত্যক্ষ মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল পরোক্ষ মৃত্যুর ঘটনা। ২০২০ সালে বিশ্ব যেন এরকম এক দৃশ্যপটের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে।

শত্রু যখন কেবল ভাইরাস নয় :

কোভিড-১৯ মহামারীর শুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জনগণকে আশ্বস্ত করতে নানা ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছিল। হাসপাতালের বেড এবং ভেন্টিলেটর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেবল কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হচ্ছিল। যে সমস্ত ঔষধ তখনও পর্যন্ত কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়নি সেগুলো মজুদ করছিল। ডাক্তারদের বেশি সংখ্যায় মোতায়েন করা হচ্ছিল হাসপাতালের রেস্পিরেটরি ওয়ার্ডে। কিন্তু যখন সংক্রমণের হার ক্রমশ বাড়তে লাগলো, তখন সব দেশই কম-বেশি পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খেতে শুরু করলো। তখন জরুরি নয় এমন ধরনের চিকিৎসা বিলম্বিত করছিল অনেক দেশ। যেমন যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অপারেশন, ধূমপান নিরোধ কর্মসূচি, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা, দাঁতের চিকিৎসা, টিকাদান, ক্যান্সারের রুটিন চেকআপ এগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল।

কিন্তু দেখা গেল, এসব চিকিৎসা সেবাও আসলে খুবই জরুরী। ফলে একটি মাত্র রোগকে মোকাবেলায় এই তীব্র মনোযোগের পরিণামে ভয়ংকর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। গোটা বিশ্বজুড়েই এঘটনা ঘটছে। রোগীরা অভিযোগ করেছেন যে তাদেরকে ক্যান্সারের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। কিডনির ডায়ালিসিস করা হচ্ছে না। অতি জরুরী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্তের পরিণাম হয়েছে ভয়াবহ। যেমন বলকান অঞ্চলের কিছু দেশে অনেক নারী বাধ্য হয়েছে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে নিজেই নিজের গর্ভপাত ঘটাতে।আর ব্রিটেনে অনেকে নিজেরা নিজেদের দাঁত উপড়ানোর মতো চিকিৎসা করতে বাধ্য হয়েছেন।

সব সংকটেই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে গরীবরা। এবারের মহামারির ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে যে এটা গরীবদের ওপর সবচাইতে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে কিছু কিছু দেশে এইচআইভি, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়ার মতো রোগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ব্যাহত হবে। যার ফলে করোনাভাইরাস মহামারীতে যত মানুষের মৃত্যু ঘটবে, ঠিক সেরকম মাত্রার মৃত্যু দেখা যাবে এসব রোগে। আর কলেরার মতো রোগে মৃত্যুর সংখ্যা করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। যে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বেশি সেটি হচ্ছে টিকাদান কর্মসূচি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসেব করে দেখেছে এক বছরের কম বয়সী অন্তত আট কোটি শিশু এখন পোলিও, ডিপথেরিয়া এবং হামের সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। কারণ ৬৮ টি দেশে করোনাভাইরাসের কারণে এই রোগগুলোর টিকা দেয়ার কর্মসূচি ব্যাহত হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে পোলিও রোগ আবার ফিরে আসতে পারে। যদিও গত কয়েক দশক ধরে শত শত কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে এই রোগ নির্মূলের জন্য। অথচ গোটা বিশ্ব এই রোগটি নির্মূল করার একেবারের কাছাকাছি চলে এসেছিল। যেভাবে নির্মূল করা হয়েছিল গুটিবসন্ত।

মহাদুর্ভিক্ষের পদধ্বনি :

এদিকে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহি পরিচালক ডেভিড বিসলি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে বিশ্ব এখন এক মহাদুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হওয়ার উপক্রম হয়েছে। অন্তত আরও ১৩ কোটি মানুষ অনাহারের শিকার হতে পারে। এরকম অনাহারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা এখনই সাড়ে তের কোটি।

বিশ্বজুড়ে নানান দেশে যে লকডাউন জারি করা হয়েছে এবং এর ফলে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে বিপর্যস্ত, তার বহু হতাশাগ্রস্ত মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। অনেকে হতাশার কারণে অতিরিক্ত মদাসক্ত হয়ে পড়বে, আত্মহত্যা করবে অনেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিন্স ইউনিভার্সিটির এপিডেমিওলজিস্ট টিমোথি রবার্টন এবং তার সহকর্মীরা মহামারির শুরু থেকেই এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বলেন, “২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রমণের পর যেভাবে তার মোকাবেলা করা হয়েছিল, আমাদের অনেকেই সেটা নিয়ে কাজ করেছি এবং আমরা জানি যে এরকম পরিস্থিতিতে এরপর কী ঘটতে পারে।”

এই গবেষক দল বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন কোভিড-১৯ গরীব দেশগুলোর নারী এবং শিশুদের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে সেটা জানতে। করোনাভাইরাস খুব বেশি ছড়িয়ে পড়লে কিরকম পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে তার দুটি চিত্র তারা দেখতে পেয়েছেন নানা মডেলিং এর মাধ্যমে। মনে করা হয়, এর একটি হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার বিপর্যয়। টিমোথি রবার্টন বলেন, “ধরা যাক, এর একটা কারণ হতে পারে মানুষ হয়তো অসুস্থ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে ভয় পাবে। এটা হচ্ছে চাহিদার দিক থেকে।”

“তবে এর পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার সরবরাহের দিকটাও মনে রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন এবং তাদেরকে হয়তো এই মহামারি মোকাবেলায় বেশি কাজে লাগানো হবে। অথবা হয়তো ঔষধের বিরাট ঘাটতি দেখা দেবে।”

আরেকটি বড় সমস্যা তৈরি হবে যখন অনেক পরিবার যথেষ্ট খাদ্য পাবে না এবং এর ফলে তাদের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। সব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন যে সবচাইতে খারাপ পরিস্থিতিতেও স্বাস্থ্য সেবার সক্ষমতা প্রায় ৫০ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং অপুষ্টি একইভাবে বাড়বে। প্রায় ১০ লাখ শিশু এবং ৫৬,৭০০ মা করোনাভাইরাস মহমারির কারণে পরোক্ষভাবে মৃত্যুর শিকার হবেন। বেশিরভাগ শিশু নিউমোনিয়া বা ডায়ারিয়াজনিত পানিশূন্যতার কারণে মারা যাবে। আর মেয়েদের বেলায় এটি ঘটবে গর্ভাবস্থায় সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে। এসব মৃত্যুর সংখ্যা যখন যোগ করা হবে দুর্ভিক্ষের কারণে ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যার সঙ্গে, তখন কিন্তু এটা বিশাল এক সংখ্যায় দাঁড়াবে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বিভিন্ন দেশে এখন প্রতিদিন অন্তত ১০ কোটি মানুষকে নিয়মিত খাদ্য সাহায্য দেয়। এর মধ্যে এমন তিন কোটি মানুষ আছেন যারা এই সাহায্য না পেলে বাঁচবে না। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির বিশ্লেষণ অনুযায়ী, সামনের মাসগুলিতে প্রতিদিনেই অনাহারে মারা যেতে পারে তিন লক্ষ মানুষ, যদি তাদের বর্তমানে তাদের বর্তমানে দেয়া খাদ্য সাহায্য অব্যাহত রাখা না যায়। এই সংখ্যার মধ্যে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি যারা এই মহামারির কারণে নতুন করে দুঃস্থ মানুষের পরিণত হয়েছেন। বর্তমান বিশ্ব মহামারি নতুন করে শুধু আরও ১৩ কোটি মানুষকে প্রায় অনাহারের দিকেই ঠেলে দেয়নি, এটি বড় বড় দাতা সংস্থাগুলোর জন্য তহবিলের সংকটও তৈরি করেছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হেড অব কমিউনিকেশন্স জেইন হাওয়ার্ড বলছেন, “যদি বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধাক্কা খায় এবং বিভিন্ন দেশ আগের মত আর আমাদের তহবিল দিতে না পারে, তখন এমন একটা অবস্থা তৈরি হবে যেটা আসলেই আতঙ্কজনক।”

ঠিক কীভাবে কোভিড-১৯ লোকজনকে একটা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে ঠেলে দেবে সেটা একটু জটিল, বলছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে এনজিওদের ডকুমেন্টারিতে অনাহারে-অপুষ্টিতে ভোগা হাড়জিরজিরে মানুষের যেরকম ছবি সচরাচর দেখা যেত, সেসব মানুষ থাকতো সাব সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে। কিন্তু আজকের দিনে অপুষ্টি বড় বড় শহরেরও সমস্যা। আর এসব জায়গাতেই করোনা ভাইরাস মহামারি সবচেয়ে জোরে আঘাত হানবে।

“যদি আপনি একটা গ্রামে থাকেন, আপনার হয়তো অন্তত তরিতরকারি ফলানোর এক খন্ড জমি থাকবে। আপনার চাচীর হয়তো একটা গরু থাকবে, তিনি আপনাকে কিছু মাংস দিতে পারবেন। আপনার হয়তো বেঁচে থাকার মত কিছু সাহায্য অন্তত থাকবে। কিন্তু একটা শহরে আপনি কিন্তু একেবারেই কিন্তু অন্যের করুণার ওপর নির্ভরশীল, বাজারে জিনিসপত্রের দামের ওপর নির্ভরশীল।”

এই মুহূর্তে সবচাইতে বেশি উদ্বেগ হচ্ছে দিনমজুর, রিকশাচালক এবং নির্মাণ শ্রমিকদের নিয়ে।

মহামারি এবং বয়সের ধাঁধাঁ :

কিছু দেশে কেন ভাইরাসের মৃত্যুর চেয়ে পরোক্ষ মৃত্যুর ঘটনা অনেক বেশি হবে, তার অন্য একটি কারণ আছে। সেটি হচ্ছে বয়স। এটা সবাই জানেন যে কোভিড-১৯ বয়স্কদের বেশি কাবু করে। নিউইয়র্কের কেবল ১৩ই মের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যাদের বয়স ৭৫ বছর বা তার বেশি, করোনা ভাইরাসে তাদের মৃত্যুর হার ১৭ বছরের কম বয়সীদের তুলনায় ৮১১ গুণ বেশি।

নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কম বয়সী মানুষের সংখ্যা বেশি। যেমন ধরা যাক, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নিজের। সেখানে জনসংখ্যার মধ্যবর্তী বয়স হচ্ছে ১৫ দশমিক দুই বছর। দেশটিতে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত মাত্র ২৫৪ জন। এর বিপরীতে ইতালিতে মধ্যবর্তী বয়স হচ্ছে প্রায় ৪৫ বছর। আর এই দেশটিতে কোভিড-১৯ এ মৃত্যুর হার বেশ উচ্চ। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মারা গেছে ৩৩ হাজারের বেশি। তবে এসব মৃত্যুর জন্য এই মহামারি কতটা দায়ী সেটা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে । হয়তো এমন হতে পারে যে এই ভাইরাসের কারণে কিছু মানুষের যতদিন বাঁচার কথা ছিল, তার চেয়ে হয়তো অল্প কম বেঁচেছেন। যেমন ধরা যাক, যে সমস্ত বয়স্ক লোক কোভিড-১৯ এর কারণে উচ্চ মৃত্যু-ঝুঁকিতে, একই সঙ্গে তারা কিন্তু নিউমোনিয়া বা নোরোভাইরাসের মতো অন্যান্য মৌসুমী শ্বাসকষ্টজনিত রোগেও একই ধরণের ঝুঁকিতে।

তবে বছরের এরকম সময়ে স্বাভাবিক অবস্থায় যত মানুষ মারা যায়, এখন মারা যাচ্ছে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু পরে যখন এই মৃত্যুর সংখ্যা গড়ের নীচে নেমে আসবে, তখন এমনটা হতে পারে যে এই ভাইরাসের কারণ হয়তো বয়স্ক মানুষদের আয়ু কয়েক বছর নয়, কয়েক মাস কমে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সবচাইতে ধনী দেশগুলোতেও করোনাভাইরাসের কারণে পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা প্রত্যক্ষ মৃত্যুর সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে দীর্ঘ মেয়াদে। যেমন ধরা যাক ক্যান্সারের কথা। যখন এই মহামারি শুরু হয়েছিল তখন এই ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য যে সমস্ত কাজ করা হয় সেগুলো কিন্তু ব্যাহত হয়েছে। এর পরিণামে কিছু মানুষ মারাত্মক পরিণতির শিকার হবে।

‘ক্যান্সার রিসার্চ ইউকে’র পরিচালক সারা হিওম বলছেন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় দেরি করা যায় না। ক্যান্সার যতবেশি আগে শনাক্ত করা যায় এটির চিকিৎসা এবং নিরাময় ততো সহজ।

লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই অনেক দেশে ক্যান্সার পরীক্ষার যেসব কর্মসূচি সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। আর যাদের ক্যান্সার ইতিমধ্যে ধরা পড়েছে তাদেরকে হয়তো চিকিৎসা শুরু করার জন্য বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে। সারা হিওম মনে করেন, এই মহামারির প্রকোপ যখন ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করবে, ততদিনে চিকিৎসার অপেক্ষায় থাকা রোগীদের যে বিরাট সংখ্যা তৈরি হবে, তাদের সবাইকে চিকিৎসা দেয়ার কাজটি অনেক পিছিয়ে যাবে।

অর্থনৈতিক মন্দা :

আর সবশেষ আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দা তো রয়েছেই। জার্মানিতে ইতোমধ্যে মন্দা শুরু হয়ে গেছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন এর পর এটাই হবে সবচাইতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা। বিশ্বের অনেক ছোট-বড় স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের কর্মসূচি চালায় মানুষের দান করা অর্থের ওপর নির্ভর করে। সুতরাং অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিলে তাদের কাজ বহু বছর পিছিয়ে যেতে পারে। তাহলে কোভিড-১৯ এর এসব পরোক্ষ প্রভাব কমিয়ে আনতে কী করা যেতে পারে?

জেইন হাওয়ার্ড বলছেন, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির একজন অর্থনীতিবিদ জরুরী কাজগুলোর একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে আছে প্রত্যেকটি দেশের সরকার যাতে তাদের জনগণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থা করে। যেমন যেসব স্কুলে বিনামূল্যে খাবার দেয়া হয়, সেসব স্কুল যদি বন্ধও থাকে, তারপরও সেই খাদ্য সাহায্য চালিয়ে যাওয়া।

দ্বিতীয়ত, সাপ্লাই চেইন বজায় রাখা।

আর সবশেষে, বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোন ধরণের প্রতিবন্ধকতা পরিহার করা।

জেইন হাওয়ার্ড বলছেন, “অনেক সময় ছোট ছোট ঘটনা থেকেও কিন্তু অনেক বড় ফল পাওয়া যায়। যেমন ধরুন আপনি যদি দাবি করতে থাকেন যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত পাড়ি দিতে হয় যেসব ট্রাক ড্রাইভারদের, তাদেরকে কোয়ারেনটিনে রাখতে হবে, তাহলে কিন্তু আপনার সাপ্লাই চেইন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। আমরা তাই আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোকে অনুরোধ করেছিলাম, তাদের এরকম পরিবহন ঠিকাদারদের নামে চিঠি দিতে, যাতে তাদের ড্রাইভাররা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে।” সূত্র : বিবিসি বাংলা

সর্বশেষ সংবাদ